স্থানীয় সূত্র জানায়, আজহারীর ওয়াজ শুনতে শিশু থেকে শুরু করে লক্ষাধিক নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। বিশেষ করে রামু, সদর, উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া ও পেকুয়াসহ বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলা থেকে এসে লোকজন তার মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন। আজহারী বক্তব্য শুরু করার সাথে সাথে ১ পুলিশ সদস্য এসে তাঁকে থামিয়ে দেন। এসময় উত্তেজিত হয়ে পড়ে উপস্থিত জনতা। আজহারী নিজেই জনতাকে থামতে বলে বলেন, বসেন ভালো কথা বলছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঐ পুলিশ সদস্য আজহারীকে বলছিলেন, পুরো কক্সবাজার শহর জ্যাম হয়ে গেছে।
মাহফিলে আসা মুসল্লিরা জানান, মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ শুনতে তারা দূর-দূরান্ত থেকে দরগাহ পাড়ায় ছুটে এসেছেন। আজকের মাহফিলে দেড় লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। মাঠ ভরে বাইরে দাঁড়িয়েও ওয়াজ শুনেছেন মুসল্লিরা। এসময় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দু’পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গত ৬ জানুয়ারি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নিমসার মোকাম হাফিজিয়া মাদ্রাসা এতিমখানা কমপ্লেক্সের উদ্যোগে হাফেজ ছাত্রদের পাগড়ী প্রদান উপলক্ষে ৪৭তম বার্ষিক তাফসিরুল কোরআন মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই মাহফিলে প্রধান বক্তা উপস্থিত ছিলেন আজহারী। তার আগমনকে কেন্দ্র করে নিমসার বাজার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
হাজার হাজার মুসল্লির সমাগমে নিমসার বাজারের বিভিন্ন স্থানে ৬টি প্রজেক্টর দিয়ে ড. মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ প্রদর্শন করা হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসা মুসল্লিরা বহুতল ভবনের ছাদে, গাছের ঢালে, এবং টিনের চালে ঝুঁকি নিয়ে অবস্থান করেও তার ওয়াজ শোনেন। এরপর ৮ জানুয়ারি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলায় এক মাহফিলেও ওয়াজ করেন আজহারী। এ মাহফিলেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে দেখা গেছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। আজহারীর ওয়াজ শোনার জন্য সকালে থেকে মাহফিলে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগম ঘটে। মাহফিলস্থলে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেকে বিভিন্ন ভবনের ছাদে, গাছের ঢালে এবং টিনের চালে ঝুঁকি নিয়ে ওয়াজ শোনেন।
একই দিন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা আলতাফ নগরে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর তাফসিরুল কোরআন ও ওয়াজ মাহফিলে লাখো মানুষের ঢল নামে। একসময় আলতাফ নগরের আশপাশ এলাকা কানায় কানায় ভরে যায়। জনতার ঢল এড়াতে পাঁচটি স্থানে প্রজেক্টর বসানো হয়। তারপরও ভিড় কমানো সম্ভব হয়নি। যানবাহন সংকটে অনেকে হেঁটে মাহফিল স্থলে পৌঁছান। আবার কেউ মূল মাঠে পৌঁছতে না পেরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আজহারীর বক্তব্য শোনেন।
এদিকে, এসব ওয়াজ-মাহফিলে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন তরুণদের আইডল, সুশিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ বক্তা, ইসলামিক স্কলার মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। তার এসব ওয়াজের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও লাখ-লাখবার দেখা হয়।
সম্প্রতি একটি ওয়াজ মাহফিলে তিনি বলেন, বৌ-মায়েরা শাশুড়িকে নিজের মায়ের জায়গায় রাখবেন। কারণ, আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে এসেছেন, আর এটাইতো আপনার বাড়ি। নতুন বাড়িতে এসে নতুন মা পেয়েছেন, এটাওতো আপনার মা। উনাকে মায়ের জায়গায় বসাতে আপনার সমস্যা কোথায়?
এসময় বৌদের উদ্দেশ্যে মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, খেয়াল রাখবেন, আপনিও একদিন শাশুড়ি হবেন। আপনি আপনার শাশুড়ির সঙ্গে যে আচরণ করছেন, শেষ বয়সে আপনার ছেলের বৌ-ও একই আচরণ আপনাকে ফিরিয়ে দেবে। কারণ, প্রকৃতির একটা বিচার আছে, ওটা শেষ বিচার; প্রকৃতির খেলা বড় খেলা। অল্পকিছু ‘টেকনিক’ অবলম্বন করলেই শাশুড়ির মন জয় করা যায় উল্লেখ করে বর্তমান সময়ের আলোচিত এই ইসলামিক বক্তা বলেন, শাশুড়িরা আসলে বেশি কিছু চায় না।
‘টেকনিক’ এর ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে শাশুড়ির মাথায় একটু তেল দিয়ে দিবেন, চুল আঁচড়িয়ে দিবেন, উনার প্রেশারটা একটু মেপে দিবেন। এছাড়া অসুখ থাকলে ওষুধ খেলো কি না তা মনে করিয়ে দিবেন। আজহারী বলেন, মাঝেমধ্যে শাশুড়ির পছন্দ করা খাবার রান্না করে দিবেন, যে বক্তার ওয়াজ শুনতে পছন্দ করে সেই বক্তার ওয়াজ ডাউনলোড করে দিবেন; কারণ বয়স্ক নারীরা ওয়াজ শুনতে খুব পছন্দ করে। এছাড়া বাইরে বের হলে জিজ্ঞেস করবেন, আপনার কিছু লাগবে কি না?
এসময় শাশুড়িদের উদ্দেশ্যেও বিভিন্ন পরামর্শ দেন মিজানুর রহমান আজহারী। তিনি বলেন, অনেক শাশুড়ি আছেন, যারা পান থেকে চুন খসলেই বৌ-মাদের সঙ্গে রেগে যান, পদে-পদে তাদের ভুল ধরেন। এটা করবেন না। বৌ-মাদের উপর অত্যাচার করবেন না, তাকে ভালবাসুন। কারণ, সেতো নতুন। আপনার অনেক অভিজ্ঞতা। আপনার মত অভিজ্ঞতা হতে তার সময় লাগবে।
না বুঝে বৌ-মাকে অনেক শাশুড়িই বদদোয়া দেয় উল্লেখ করে আজহারী বলেন, এতে নিজের পরিবারেরই ক্ষতি, আপন নাতি-নাতনিরই ক্ষতি। তাই এটা করবেন না। শাশুড়িদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, বৌ-মাদেরকে কষ্ট দিবেন না। মনে রাখবেন, আপনার নিজের মেয়েটাও আরেক বাড়িতে বৌ হয়ে যাবে। আপনি নিজের বৌ-মাকে কষ্ট দিলে আপনার মেয়েকেও কষ্ট পেতে হতে পারে, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না। এজন্য বৌ-মাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। তিনি আরও বলেন, দোষ ছাড়া মানুষ নাই। আমরা সবাই যেন সবাইকে ভালবাসি, আমরা যেন একে অন্যের দোষ না খুঁজি।
আরেক ওয়াজ মাহফিলে আজহারী বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা, উঠতি বয়সীরা তাদের যৌবন শেষ করে ফেলছে। গার্লফ্রেন্ড আর বয়ফ্রেন্ডের যে কালচার, এগুলো আগে ছিল না। যৌবনের কারণে, খারাপ সম্পর্কের কারণে যুবক বয়সে তারা যে পাপগুলো করে, এর একটা ভাগ গুনাহ বাবা-মায়েদের কাঁধেও যাবে।
বিষয়টির ব্যাখা দিয়ে তিনি বলেন, সন্তানদের যদি সময়মত বিয়ে না দেয়া হয়, যৌবনে যে পাপগুলো তারা করবে, এগুলো অভিভাবকদের কাঁধেও বর্তাবে। এজন্য সময়মত বিয়ে দিন। অভিভাবকদের উদ্দেশ্য বর্তমান সময়ের আলোচিত এ বক্তা বলেন, নিজের সন্তানদের দুঃখগুলো বুঝুন। ওরা অনেক দুঃখে আছে, কষ্টে আছে; বুক ফাটেতো মুখ ফোটে না। বিয়ের চেয়ে ভালো কাজ হয় না। সামর্থ না থাকলে বিয়েতে শুধুমাত্র খেজুর খাওয়াতে পরামর্শ দেন তিনি। আজহারী বলেন, মসজিদে বিয়ে করাবেন। ছেলের বাবা-মেয়ের বাবা চলে আসবে, খেজুর নিয়ে যাবেন ১ কেজি, বিয়ে শেষ। এদেশে ছেলে বিয়ে করতে চাইলে বলে নিজের পায়ে দাঁড়াও-এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিয়েটাকে সহজ করুন। জনপ্রতিনিধিরা একটু দায়িত্ব নিন। বিয়েটা ভালোবাসার বন্ধন। বিয়ে কারও সফলতা আটকে রাখে না। সফল ব্যক্তিরা সময়মতই বিয়ে করেছেন। যারা বিয়ে করবে আল্লাহ নিজ দায়িত্বে তাদের সম্পদশালী বানিয়ে দিবে।
উল্লেখ্য, মিজানুর রহমান ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার ডেমরায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগরের পরমতলা গ্রামে। তার বাবা একজন মাদরাসার শিক্ষক। তার পরিবারে মা-বাবা ও এক ভাই রয়েছে।