জীবনের কর্মফল।। জামিল হাসান নাঈম

অন্যকারোর না বরং নিজের কথাই বলি ।
২০১৮ সালের নভেম্বরে এক মেয়েকে বিয়ে করি । ফেসবুকে পরিচয় ছিলো । ২ মাসের প্রেম করে বিয়ে করি । সেসময় প্রেম করাটাকে ধর্মমতে আমার নিষ্দ্ধি মনে হওয়ায় তারাতারি করেছিলাম ।

আমিও ছাত্র ছিলাম সেও ছাত্রী ছিল । আমার বাসা চাঁপাইনবাবাগঞ্জ তার বাসা ঢাকা । প্রতিমাসে আমি বাসা থেকে লুকিয়ে চাঁপাই থেকে ঢাকা যেতাম তার সাথে দেখা করতে । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ঘুরেফিরে সন্ধ্যার বাসে ফিরে আসতাম আবার ।

জীবনের প্রথম কোনো মেয়ের সাথে পরিচয় এবং ভালোবাসা তাই মনে কোনো সন্দেহ ছিল না । ভেবেছিলাম তাকেই তো ভালবাসি, তাকে পেলেই চলে যাবে সে অতীতে কেমন ছিলো তার পরিবার কেমন সেসব জানার আগ্রহ ছিলো না । বাসার সবার সাথে রাগারাগি , জেদাজেদি করে মেয়েটাকে বিয়ে করি ।

বাবা-মা এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে একসময় বাসা থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন । পরে এলাকার মানুষদের বলায় তারা আমার পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমার এবং আমার বউয়ের সকল দায়িত্ব নিয়েছিলেন । মা কখনো মেয়েটাকে দিয়ে বাসার কাজ করাতেন না । বাবা আমার সাথে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন । আত্মীয়-স্বজন কেউই আমার সাথে মৌখিক কথাও বলতেন না ।

তবে বিয়ের আগের মত বেকার না থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি এক কম্পিউটারের দোকানে কাজ করা শুরু করি । রোজ সকাল ৭ টায় বাসা থেকে ২৭ কি.মি দূরে শহরের সেই দোকানে যেতে হতো আবার রাত ১০ টার পর ফিরে আসতাম । আমার বউ বাসায় কি করতো জানতাম না কিছুই শুধুমাত্র সে যেটুকু বলতো সেটুকু ছাড়া । কিন্তু উরাধুরা বিভিন্ন খবর কানে আসত ।

৬ মাস কাজ করার পর সারাদিন রাত্রির পরিশ্রম দেখে সেই কাজ ছাড়িয়ে দিলেন বাবা । বললেন বাড়িতে থেকেই কিছু করতে । আমি এক কোচিং সেন্টারে পড়ানোর কাজ শুরু করলাম, জীবনের প্রথম কয়েকটা টিউশনিও পেলাম টিউশনি করাই আর বাড়িতে থাকি ।

-বাড়িতে থাকার সুবাদে আমার সেই প্রিয় ভালোবাসার মানুষের মুখোস আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে খুলতে শুরু করলো । বিভিন্ন অপরাধ করতে যেয়ে হাতে হাতে ধরা পরতে লাগলো । একে একে বেরিয়ে আসল তার অতীত জীবনের ঘটনা ।

-আমার বাবা গ্রামের একজন স্কুলের শিক্ষক । তার মান সম্মান পুরো এলাকার মধ্যে অনেক বেশি । সেই মান সম্মানে সেই মেয়ের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় আঘাত আসলো যখন সে আমাদের এক পরিচিত ছোট ছেলেকে দিয়ে (সেই ছেলেটি তার কাছে অপিরিচিত ছিলো) সিগারেট এনে গ্রামের ব্যাস্ত রাস্তার পাশে দাড়িয়ে খেয়েছিলো এবং তা বেশ কয়েকজন পরিচিত মানুষ দেখেছিলো ।

-এর পরের কাজ ছিলো আমার অনুপস্থিতিতে তার পুরোনো প্রেমিকদের সাখে কথা বলা । বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তাদের কাছে আবার ফিরে যাবে সেই আশা দিয়ে তাদের সান্তনা দেয়া ।

-কাউকে না বলে বাড়ি থেকে যখন তখন বের হয়ে যাওয়া । অপরিচিত জায়গায় সে কোথায় কোথায় যেত জানতাম না , সে বলতোও না । অনেক কথা কানে আসতো । জিঞ্জেস করলে ঝগড়া শুরু হতো ।

-যখন তখন ঝগড়া করতো । ঝগড়ার সময় নিজেই নিজের হাত কেটে ফেলত ব্লেড দিয়ে । বাবা-মা কাওকে গালাগালি করতে ছাড় দিতো না । এমনকি একদিন ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে যায় । এবং কিছুক্ষণ পর বাবার সামনে সিগারেট টানতে টানতে বাসায় ফিরে আসে । সেদিন বাবার অবস্থা কি হয়েছিল বলার মত না তবে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছিলো ।

পরে জেনেছিলাম সে ঢাকার বস্তির এক উড়নচন্ডী মেয়ে ছিলো । মেয়েদের থেকে বরং তার ছেলেবন্ধুই ছিলো সবথেকে বেশি । এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা সে সেই ১৮ বছর বয়সে করেনি । এবং আমার এখানে পালিয়ে এসেছিলো কোন পুলিশি মামলা থেকে বাঁচার জন্য । ( তাকে কিন্তু আমি নিয়ে আসিনি বরং একদিন সকালে আমাকে ফোন দিয়ে বলে সে আমাকে ভালবাসে তাই তার শহর ছেড়ে আমার গ্রামে চলে এসেছে ।)

আরো অনেক ঘটনা আছে যা বলার মতো না এতটাই বিশ্রী । শেষ পর্যন্ত আমি আর এসব সহ্য করতে পারিনি । ১০ মাসের মতো সংসার করে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আমাদের । অথচ তার পরিবারের এসবে কোনো মাথাব্যাথাই নাই । তারা তাদের মেয়ের চরিত্র এবং কাজ সম্পর্কে সবই জানে ।

এখন ফেসবুকে লুকিয়ে ফেইক-আইডি দিয়ে খোজ নেই । দেখি সে আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে । আবার সেই বন্ধু, নতুন প্রেমিক , সিগারেট-গাঁজা-ইয়াবা সহ নিত্য নতুন কার্জকলাপ সহ ছবি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে , আমি লুকিয়ে দেখি ।

  • এবার আসি আমার কথায় । আমার কর্মফলের কথায় ।
    আমি যে বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে বাবা মাকে যত কষ্ট দিয়েছি সেই কষ্টই আমি ফিরে পেয়েছি । বাবা-মাকে কাঁদানোর ফলাফল হিসেবে আমিও রাতের পর রাত কেদেছি ।
    আমার পড়াশোনা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে ।
    এলাকায় যেখানে সবার মুখে মুখে আমার সুনাম ছিলো । এখন দুর্নাম ছাড়া আর কিছু নেই ।
    লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা , দেখা করতে যাওয়া এসব জানার পর আমার উপর থেকে সবার বিশ্বাস চলে গেছে ।
    প্রত্যেক মুহুর্তে আত্মগ্লানিতে, অপরাধ বোধে ভুগি । প্রতিমুহুর্তে বাবা-মায়ের সেই কান্নাভেজা চোখ মনে পরে । বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই চলে যায় (এই যে মারাত্মক অপরাধবোধ নিয়েও বেঁচে আছি তাও তাদের দিকে তাকিয়ে ।)

    সর্বোপরি আমার যে একটা উচ্চ অবস্থান ছিলো সেখান থেকে এক ঝটকায় মাটিতে এসে পরি শুধুমাত্র একটা ভুলের জন্য, পাপের জন্য, বাবা-মাকে দুঃখ দেবার জন্য, বিশ্বাস নষ্ট করার জন্য । অনেক বুঝিয়েছিলো তারা , চিনিনা জানিনা, বাসা, বাড়িঘর পরিবার কিছুই জানিনা তাকে বিয়ে করা ঠিক না , কিন্তু আমি শুনিনি ।    
                                     লেখক:-

B.S.C পদার্থবিদ্যা & দর্শন,
 নবাবগঞ্জ সরকারী কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
Previous Post Next Post